মিডলাইফ ক্রাইসিস: উত্তরণ করতে হবে|| ইকবাল অাহমদ চৌধুরী

ইকবাল অাহমদ চৌধুরী:

ইংরেজিতে একটা ফ্রেইজ আছে “Bivouac of life”। এর বাংলা অর্থ হলো ‘ক্ষনিকের জীবন’ বা অস্থায়ী জীবন। ‘বিভোয়াক’ শব্দটি ফ্রেঞ্চ থেকে ইংরেজিতে এসেছে। লিটারেচারে এটি খুব সার্থক উপায়ে ব্যবহার করেছেন অ্যামেরিকান জনপ্রিয় কবি ও লেখক হেনরি ওয়াডসওয়ার্থ লংফেলো (Henry Wadsworth Longfellow)।

 

লংফেলো ১৮০৭ সালে অ্যামেরিকার পোর্টল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। হার্ভার্ডের প্রফেসর ছিলেন। লেখালেখিতে অধিক মনোনিবেশ করার অভিপ্রায় নিয়ে ১৮৫৪ সালে অধ্যাপনা পেশা থেকে অবসর নেন। ইউরোপে প্রচুর আসা যাওয়া করতেন তিনি। এ কারণে তাঁর লেখালেখির মধ্যে ইউরোপিয়ান স্টাইল, মিথোলজি এবং ইউরোপিয়ান ঘটনা প্রবাহ বেশি প্রতীয়মান হয়। তাছাড়া বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় জীবন ও জনসাধারণ ঘনিষ্ট বিষয় গুলো তাঁর লেখালেখির অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠেছিল।

 

জীবন দর্শন নিয়ে  ‘A Psalm of life’ নামে তিনি একটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছেন। ৯ স্ট্যাঞ্জার ৩৬ লাইনের কবিতা। জীবনের আশা, আকাংখা এবং উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন এখানে নিখুঁত ভাবে। পৃথিবী আমাদের জন্য এক সংক্ষিপ্ত সময়ের যাত্রা মঞ্চ। জীবন চলার পথে দুঃখ-বেদনা, বাধা-বিঘ্ন সব কিছু আসবে; এসব মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয় নিতে হবে। কবিতায় এ বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে অসাধারণ ভাবে।

 

In the world’s broad field of battle,

In the bivouac of Life,

Be not like dumb, driven cattle!

Be a hero in the strife!

 

অর্থাৎ-

“পৃথিবীটা হলো যুদ্ধের বিশাল এক ময়দান,

এই সংক্ষিপ্ত জীবন যাত্রায়;

নীরব হয়ে বসে থাকলে চলবেনা, গবাদি পশুর ন্যায় হতে হবে কর্ম তৎপর চলমান!

বিজয়ী হতে হবে সমস্ত দ্বন্দ্ব-বিবাদ, শত্রুতা-বৈপরীত্ব এসবের মোকাবেলায়!”

 

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা হয়ে গেলে আমাদেরকে কবরের অন্ধকার জগতে পাড়ি দিতে হয়। পৃথিবীর জীবন তখন একেবারে থমকে যাবে। কিন্তু, কবরে যাওয়া জীবনের মূল লক্ষ্য নয়! শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবার, সমাজ আর সভ্যতার কল্যাণে কতটুকু কাজ করা গেল- সেটাই জীবনের মূল বিবেচ্য বিষয়। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে প্রাণহীন অন্তরাত্মা এগুলোরই স্বাক্ষী দেবে অতি উচ্চস্বরে! লংফেলো তাঁর কবিতায় লিখেছেন-

 

Life is real! Life is earnest!

And the grave is not its goal;

Dust thou art, to dust returnest,

Was not spoken of the soul.

 

ব্যক্তি জীবনের বাস্তব উপলব্ধি নিয়ে হেনরি ওয়াডসওয়ার্থ লং ফেলো’র আরেকটি বিখ্যাত কবিতা আছে। নাম Mezzo Cammin। ১৪ লাইনের কবিতা। Mezzo শব্দের অর্থ মিডল বা মাঝারি। Cammin জার্মানির একটি শহরের নাম।

 

ওয়াডসওয়ার্থ লংফেলোর বয়স যখন পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর; তখন একবার অসুস্থ হয়েছিলেন। চিকিৎসা নিতে জার্মানির ক্যামিন শহরে আসেন। শরতের স্নিগ্ধ রাত, আলো আধারির জ্বলমলে ভরা জার্মানির ক্যামিন শহর তাকে তখন আকৃষ্ট করতে পারেনি। নানা দুশ্চিন্তা তাকে আস্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরল!

 

হঠাৎ তাঁর মনে হলো জীবনের অর্ধেক তিনি পার করে দিয়েছেন! তারুণ্য, যৌবন আর সামর্থের শ্রেষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলো। অথচ উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই তিনি করে যেতে পারেননি! এখন মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছেন। জীবনের কোনো স্বপ্ন পূরণ করার আর কোনো সম্ভাবনা তাঁর হাতে নেই। লংফেলোর কবিতার ভাষায়-

 

Half of my life is gone, and I have let

The years slip from me and have not fulfilled

The aspiration of my youth, to build

Some tower of song with lofty parapet.

 

মিড্ লাইফে এসে ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে নানা দ্বন্দ্ব, কনফিউশন তৈরী হয়। এ সময় হতাশা, দুঃখ আর গ্লানিবোধ- মানুষকে চরম ভাবে বিধস্ত করে ফেলে। জীবনের এই মিড্ থার্টি বয়সে প্রত্যেক মানুষই নাকি এ ধরণের দ্বন্দ্ব আর দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে যান। ওয়াডসওয়ার্থ লং ফেলো এটিকে ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

 

কবিতার শেষ দিকে এসে লংফেলো সুর বদলে ফেলেন। পিছনের ভুলগুলো আর অনুশোচনার ধূসর জ্বাল ছিন্ন করে জেগে ওঠার দ্বীপ্ত ঘোষণা দেন। জীবনকে পাহাড়ের উঁচু চূড়ায় আরোহনের ‘অর্ধেক মাত্র পথ’ পাড়ি দিয়েছেন বলে ভাবতে শুরু করেন।

 

মাঝপথে এসে হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে সামনের লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় গ্রহণ করেন। এক নিমিষে তিনি তাঁর অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্যালকুলেশন করে ফেলেন। সামনে মৃত্যু অবধারিত এটা জেনে নিয়েই তাঁর সমস্ত অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

 

মূলত কবিতাটি ছিল ওয়াডসওয়ার্থ লংফেলোর জীবন ভিত্তিক মানুষের বাস্তব ভাবনা নিয়ে রচিত। মধ্য বয়সে মানুষের যে আবেগ অনুভূতি এটা সুনিপুন ভাবে এখানে কবিতার লাইনে লাইনে চিত্রিত হয়েছে। ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস’ ব্যাপারটা বাস্তব। এই সময়ে প্রেম, বিরহ, পরিবার, সমাজ, চাকরি, আর্থিক টানাপোড়েন- একেক মানুষের জীবনে এটি একেকভাবে আপতিত হয়।

তবে এখানে থেমে যাওয়া; কিংবা নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার মত চিন্তা করা একেবারে অমূলক। দুঃখ, হতাশা, রাগ, অভিমান- সব কিছু ছাপিয়ে সামনের দিকে আলোর পথের অভিযাত্রী হতে হবে। জীবনে বেঁচে থাকার আয়ু যত দিনের হোক; তার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করা আমাদের কর্তব্য। ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের কল্যাণে নিজের সময়কে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানোর মধ্য দিয়েই জীবনের মূল স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়।

 

উনিশ শতকের অ্যামেরিকান সাহিত্যে ওয়াডসওয়ার্থ লংফেলো সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। শেষ বয়সের ছবিতে তিনি লম্বা শাদা চুলের এবং শশ্রুমন্ডিত হয়েছিলেন। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখচ্ছবির সাথে তাঁর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ১৮৮২ সালে ৭৫ বছর বয়সে অ্যামেরিকার ম্যাসাচুয়েটসে লংফেলো মৃত্যুবরণ করেন।

 

… …………… ..

ইকবাল চৌধুরী

অক্সফোর্ড, ইংল্যান্ড

২১-০৮-২০২০