সর্বশেষ

» বাংলাদেশের সংবিধান, নারী অধিকার: প্রেক্ষাপট নারী আইনজীবী

প্রকাশিত: ১৩. নভেম্বর. ২০২০ | শুক্রবার

এডভোকেট জেসমিন সুলতানা::

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ৪ঠা নভেম্বর পালিত হয় সংবিধান প্রনয়ন দিবস। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী হিসেবে প্রকৃত সাংবিধানিক অধিকার বঞ্চিত নারীদের হয়ে এই লেখাঃ

 

পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের মতোই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সনের ৪ঠা নভেম্বর রচিত হয় এবং একই সনের ১৬ই ডিসেম্বর তা  কার্যকর হয়।। বাংলাদেশের সংবিধান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। এখানে মানুষের মৌলিক অধিকারসহ নারীর অধিকারগুলো বিভিন্ন অনুচ্ছেদে অত্যন্ত সুনিপুন ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা নারীর আপন সত্তাকে উদ্ভাসিত করে।

 

বাংলাদেশের সংবিধান নারীর অধিকারের প্রতি এক অসাধারণ স্বীকৃতি। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষে বৈষম্য করার কোনও সুযোগ নেই। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আছে- “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী”। এছাড়া, সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে আছে- “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না” আবার সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে আছে- “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন”। সংবিধানের ২৮(৩) অনুচ্ছেদে আছে- “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী- পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না”। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে- “নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না”।

 

সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে আছে-  “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের সমতা থাকবে”। সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে আছে- “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না”। সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। আবার ৯ অনুচ্ছেদের অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

মনে পরে একটি উক্তি যা আমাদের প্রয়াত প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ সাহেব করেছিলেন- “যত সুন্দর ভাষা ও শব্দ দিয়ে সংবিধান লেখা হোক না কেন, জাতির জীবনে তা প্রয়োগ না হলে সেটা অর্থহীন হয়ে পড়বে”। বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে মনে করি প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার সর্বোচ্চ আদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট , সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নারীরা। এখানে নিয়োগ, পদায়ন, মনোনয়নসহ সব কিছুতেই  সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার  থেকে নারী আইনজীবীরা বঞ্চিত। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বাঙালীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ধারক, বাহক ও অভিভাবক। আমরা যদি সর্বোচ্চ আদালতের দিকে অবস্থানগত দিক থেকে  তাকাই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে মাননীয়  প্রধান বিচারপতিসহ  রয়েছেন সাতজন মাননীয়  বিচারপতি কিন্তু বর্তমানে আপিল বিভাগে কোন নারী বিচারপতি নেই। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে মাননীয়  বিচারপতি মোট ৯২ জনের মধ্যে নারী বিচারপতি মাত্র  ৬জন।

 

তাছাড়া এটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে মাননীয় এটর্নী জেনারেল, এডিশনাল এটর্নি জেনারেল পদে কোন নারী নেই। ডেপুটি এটর্নি জেনারেল ৬৭জনের মধ্য ১২জন নারী। এ্যাসিস্ট্যান্ট এটর্নী জেনারেল ১৫১জনের মাঝে ৫৭জন নারী। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ছাড়া অন্য কোন জেলায় নারী পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অথবা জিপি আছেন বলে জানা নেই।

 

সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের ২০২০-২০২১সনের নির্বাচিত কমিটিতে চৌদ্দটি পদে মাত্র একজন নারী সদস্য, যদিও ৮০০জন মতো নারী আইনজীবী রয়েছেন তবে কোন ভাল পদ, পদবীতে নারীদের নমিনেশন কোন দল থেকেই দেয়া হয়না। সারা বাংলাদেশে মোট আইনজীবী ৫৮হাজারের মতো, এর মাঝে নারী আইনজীবী প্রায় দশ হাজার। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে নারী প্রতিনিধি নেই, নির্বাচনে নারীদের নমিনেশন দেয়া হয়না আর নমিনেশন পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ও বটে। যোগ্য নারী যে নেই তাতো না, নারীদের যোগ্যতা নজরে আসেনা। আর কত বড় হলে যোগ্য হবে নারী? বারের সভাপতি, সম্পাদক পদে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টসহ অন্যান্য জেলা বার এসোসিয়েশনগুলোতে মনোনয়ন দেয়া হয়না বললেই চলে তবে দু’একটা বার এসোসিয়েশনে ভাগ্যক্রমে দু’একজন সম্পাদক হয়েছেন যা খুবই নগন্য। সভাপতি,সম্পাদকের পদে নমিনেশন? সেতো আকাশকুসুম কল্পনা, একেবারে দিবাস্বপ্ন দেখার মতো।

 

আমরা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, নারী নেতৃত্বের কথা বলি, নারী অধিকারের কথা বলি, নারী অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আমরা সোচ্চার অথচ সবচেয়ে বঞ্চনার শিকার সর্বোচ্চ আদালতের নারীরাই। আদালতে অনেক মেধাবী নারী আইনজীবী রয়েছেন। মেধাবী বলেই অত্যন্ত সততার সাথে দক্ষতার সাথে সুযোগ পেলে কাজ করে যাচ্ছেন নারী আইনজীবীরা- সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্ঠা হিসেবে, নিজ স্বাধীন পেশায়।

 

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী তাই তিনি সবসময় যেকোন নিয়োগে নারীদের চান, প্রত্যাশা করেন নারীর ক্ষমতায়ন। কিন্তু দুঃখজনক যে আমাদের নীতিনির্ধারকগণ যোগ্যতাসম্পন্ন কোন নারী আইনজীবী খু্ঁজেই পাননা যাদের পদায়িত করা যায়। দেশ বিদেশের ডিগ্রিধারী  মেধাবী যোগ্য অনেক নারী আইনজীবীই আছেন আমাদের, তাদের প্রতিভার কোনো মূল্যই কি নেই? প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি পূর্ণরূপে বিশ্বস্ত থাকলে বাংলাদেশের নারীর প্রতি কোনও রকম বৈষম্য থাকার বা বৈষম্যমূলক কোনও আচরণ করার সুযোগ নেই। তারপরও এখানে অনেক নারী বঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার। অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন নারীরা। কখনো লাভবান কখনোবা আবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভালো লাগে উপলব্ধিতে যখন দেখি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্বপ্নসারথি একজন নারী, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার একজন নারী, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদে ৪ জন নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, মাননীয় সাংসদ সরাসরি নির্বাচিত ২২জন এবং সংরক্ষিত ৫০টি আসনে নারী। গর্ব করি নড়াইল,মৌলভীবাজার, নরসিংদী, রাজবাড়ি, পঞ্চগড়, শেরপুর, কুড়িগ্রাম, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে সততা ও দক্ষতার সাথে কাজ করছেন নারী। সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে ১০জন সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন নারী। পুলিশ প্রশাসনে ৬৯জন এস,পি, ৫ জন ডি আই জি’র দায়িত্ব পালন করছেন নারী। বিচার বিভাগে জেলা জজের দায়িত্ব পালন করছেন নারী। দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন নারী। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন নারী, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করছেন নারী, বিভিন্ন এনজিও’তে  সি ই ও পদে নারী, সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠনে নারী। কবিতা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে অবদান রাখছে নারী, ক্ষুদ্র, মাঝারী শিল্প-উদ্যোক্তাসহ গার্মেন্টস শ্রমিক হিসাবে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন নারী, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হয়ে ভূমিকা পালন করছেন তারাও নারী। সর্বোপরি একজন মা হিসেবে, স্ত্রী হিসাবে, কন্যা হিসেবে গর্বিত নারী।

 

সংবিধানে বাংলাদেশের  রাজনৈতিক দলগুলোতে এক তৃতীয়াংশ নারীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন আইনে  নীতিমালায়, নারীর প্রতি সর্বপ্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদে নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু সামাজিকভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংবিধান নিয়ে চর্চা করা, সাংবিধানিক অধিকার আদায়ে  সবচেয়ে বেশী সোচ্চার নারীরাই বঞ্চনার শিকার। সাংবিধানিক অধিকার এবং আইন থাকলেও নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাজ করছে সমাজের সর্বক্ষেত্রেই। তবে একটি কথা না বললেই নয় আমাদের পুরুষদের সাথে কোন বৈরিতা বা প্রতিযোগিতা নেই। আমরা চাই আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের সঠিক প্রয়োগ  আদায় ও বাস্তবায়ন। যতদিন নারীর যথার্থ মূল্যায়ন না হবে, নারী তার প্রকৃত হিস্যা না পাবে ততদিন সার্বিক উন্নয়ন কখনোই সাধিত হবেনা কেননা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রেখে, বঞ্চিত রেখে পূর্নাঙ্গ, সার্বিক সফলতা কখনো আসতে পারেনা। কোন দয়া দাক্ষিন্য নয়, নারী তার সাংবিধানিক অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর। দেশের মানুষ  তাই দেশমাতৃকা, দেশের মাটি ও মানুষের সেবাই  হোক মহানব্রত।

 

লেখকঃ

আইনজীবী

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।

 

image_print
           

সর্বশেষ

আর্কাইভ

November 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930