জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ সহ সকল বইয়ের জন্য উন্মুক্ত হোক বইমেলা ‘২৪

আতিকা নুরী:

দরজায় কড়া নাড়ছে একুশে বইমেলা ২০২৪। বাঙালির প্রাণের মেলা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির এই মেলা ঘিরে বাংলাদেশের লেখক,প্রকাশক ও পাঠকদের অপেক্ষা এবং উৎসাহের কমতি নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক কতটা স্বাধীনভাবে সাহিত্য চর্চা করা যায়-তা নিয়ে যথেষ্ট পর্যালোচনা সময়ের দাবী।

বিশ্বজুড়েই সাহিত্য চর্চায় কতটা স্বাধীনতা আছে, সমাজ ধর্ম বা রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাহিত্য কি কোনো কালে আপন গতিতে চলতে পেরেছে-সে প্রশ্নও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না-এ কথা যেমন সত্য, তেমনি বই লিখে অনেকে দেশছাড়া হতে হয়েছে সেটাও চরম সত্য। বাংলাদেশে এরকম ঘটনা আরো নিদারুন সত্যে পরিণত হয়েছে। আমি/আমরা,আমাদের মত অনেক লেখক-কবি সাহিত্যিক ও ব্লগার স্বাধীন মত প্রকাশের কারণেই দেশ ছাড়া হয়েছেন।

বাংলাদেশে প্রথম লেখার জন্য দেশ ছাড়া হয়েছিলেন দাউদ হায়দার। তিনি কবিতা লিখে নির্বাসিত হন। দাউদ হায়দারের কবিতা নিষিদ্ধ হয়।
১৯৯৩ সালে সেবার তসলিমা নাসরিনের লজ্জা বইটি নিষিদ্ধ হয়। নারীবাদ নিয়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বই ‘নারী’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ১৯৯৫ সালে। ২০০০ সাল পর্যন্ত ওই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। মৌলবাদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ-বাদ’ বাংলাদেশের একটি শ্রেণীকে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ করেছিল।

জান্নাতুল নাঈম প্রীতি-তিনিও বই লিখে নির্বাসিত হয়েছেন। ২০২৩ সালে প্রীতির ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। এখনো সে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। গত বছরের একুশে বইমেলায় ১৪তম দিনে বইটি নিষিদ্ধ করে বইমেলার জন্য বাংলা একাডেমি গঠিত টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের নির্দেশে ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিকেলেই মেলার স্টল থেকে বইটি তুলে নেয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নালন্দা। সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে টাস্কফোর্সের সভাপতি অসীম কুমার বলেছিলেন,বইটিতে মেলার নীতিমালা পরিপন্থী নানা বিষয় উঠে এসেছে।

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমাজে কতোটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-প্রীতির বই নিষিদ্ধের ঘটনা থেকেই তা অনুমান করা যায়।

যে দেশে লেখার কারণে সাহিত্যিকদের হাত পা বেঁধে দেওয়া হয়, হাতের কলম থামিয়ে দেওয়া হয়,দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয় ও বই নিষিদ্ধ করা হয়-সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে এটা বলা বেমানান।

গত বছর জান্নাতুন নাঈম প্রীতির লেখা ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইটি কি কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ? বাংলা একাডেমি যদিও তার কারণ উল্লেখ করেছে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এ কারণটি অজুহাত মাত্র। মূলত কট্রর ধর্মপন্থীদের সমালোচনার ভয়েই হয়ত বাংলা একাডেমি জান্নাতুন নাঈম প্রীতির বইটি নিষিদ্ধ করেছিল৷

বইমেলায় বই নিষিদ্ধের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছিল যে,লেখক-সাংবাদিকদের স্বাধীনতার কথা শুধু বাংলাদেশ সংবিধানেই আছে, বাস্তবে নেই। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে একটি বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা নিশ্চয়ই লেখক-পাঠক সবার জন্য অশনিসংকেত ৷ এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের নামান্তর।

তাই,আমি তখনই এই ঘৃণ্য সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম৷ কারণ,আমি ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে মনে করি যে,কোনো বিবেচনাতেই একটা বই নিষিদ্ধ হতে পারেনা। লেখকের লেখায় প্রচলিত আইন পরিপন্থী কিছু থাকলে তার বিরুদ্ধে সরকার আদালতে যেতে পারে। কিন্তু বইয়ের গলা চেপে ধরার অধিকার কারো আছে বলে আমি মনে করি না।

আমার কাছে মনে হয়েছে, জানাতুন নাঈম প্রীতির বই নিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদী এবং প্রগতিশীল
মৌলবাদী গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন একটা অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল-যা সহ্য করার মত ছিল না৷ উগ্রবাদী এই গোষ্টিগুলোকে খুশী করার জন্য বাংলা একাডেমি একটি বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে-তা কল্পনাও ছিল না। কিন্তু,তাই হয়েছে।

বাংলা একাডেমির উচিত,আসন্ন বইমেলায় এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া৷ জাতীয় বইমেলায় ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ সহ সকল মতের লেখকদের বই বিক্রির অনুমতি থাকাটা সময়ের দাবী। পাঠক বই কিনবে,পড়বে। পড়ার পর প্রতিক্রিয়া প্রকাশের স্বাধীনতা পাঠকের অবশ্যই আছে।গঠনমূলক সমালোচনা হলে লেখকদের মধ্যে সংশোধনের স্পৃহা বাড়বে। কিন্তু,তা না করে সমালোচনার ভয়ে একটা বই নিষিদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত নয়।

গত বছর বইমেলায় যেটা হয়োছে এর পেছনে কারো ইন্ধন ছিল কি না সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। সেসময় টাস্কফোর্সের পুলিশী আচরণ ছিল নিন্দনীয়। তাদের আচরণ বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল।

গত বছর জান্নাতুন প্রীতির কন্ঠ রোধ করা হয়েছে,এবছর অন্য কারো হচ্ছে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না।

তবে আমি আশাবাদী,এবছর বইমেলার আয়োজকরা আরো উদার হবেন। বইমেলাকে তারা ধর্ম,বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্যের উর্ধ্বে রাখবেন। বইমেলা হবে উন্মুক্ত পাঠশালা।

এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি,সরকারের উদ্যোগ এবং সিদ্ধান্ত অনেক বড় প্রভাবক। সরকার থেকে ধর্মীয় উন্মাদনা রোধের নামে মুক্তমনা লেখকদেরই হাত-পা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে।

সরকারের উচিত ছিল,যারা চরমপন্থী,মৌলবাদী,যারা জানাতুন নাঈম প্রীতি এবং তাঁর বইকে আক্রমণ করেছে-তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারণ বাক স্বাধীনতা হলো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু সেই বাক-স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা দৃশ্যমান নয়।

বই মেলা উৎসব বানচালের জন্য অনেক পূর্বে থেকেই হেফাত ও জামায়াত দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি,বাংলাদেশকে একটি কট্রর ইসলামী রাষ্ট্রে রুপান্তর করার উদ্দেশ্য মৌলবাদী দলগুলো হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের উপর ধারাবাহিক ভাবে হামলা করছে।

আমি একজন লেখক হিসেবে মনে করি,এই মানুষগুলোকেও পরিবর্তন করা সম্ভব। মৌলবাদীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদেরও শাসনের সমাপ্তি টানা সম্ভব সরকারের সদিচ্ছার মাধ্যমে। কিন্তুু,দুঃখজনক হলেও সত্য,এখনো মৌলবাদী গোষ্ঠী দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত বাংলাদেশ।

আমার দৃষ্টিতে মৌলবাদী নেতাদের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী,মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম চরমোনাই,মাওলানা হুসাম উদ্দিন চৌধুরী,মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর সাথে সরকারের ঘনিষ্টতা রয়েছে। সরকার তাদের দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত। এসব মৌলবাদী ব্যক্তিরা সবসময়ই সাহিত্য চর্চার বিরোধীতা করে থাকেন। প্রতিবছর বইমেলাকে বিতর্কিত করার জন্য তারা নানাভাবে চেষ্টা চালায়।

মৌলবাদী এসব গোষ্টির জন্য
জান্নাতুন নাঈম প্রীতির মত লেখকরা একটা আতংকের নাম। তাই,এসব লেখকদের থামানো উচিত হবে না। তাঁদের ক্ষুরধার লেখনী পাঠকদের হাতে হাতে পৌঁছাতে হবে। তাঁদের মনের দৃঢ়তা ও সাহসী লেখা সত্যিই প্রশংসনীয়। এসব লেখনী,বই ও নিবন্ধ জাতিকে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জাগাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

আমি সাহিত্যিকদের বলবো আপনারাও লেখনীর মাধ্যমে বইমেলা আয়োজকদের কাছে একই বার্তা প্রেরণ করুন।বইমেলা হলো মানুষের চিন্তা প্রকাশের অবাধ সূতিকাগার।বইমেলা লেখক-পাঠক সম্পর্কে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। এখানে কাউকে নিষিদ্ধ করা,কারো বই বা লেখনী থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা নিতান্তই বোকামী।

তাই,আসন্ন বইমেলায় ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ সহ সকল নিষিদ্ধ বই পুনঃরায় ফিরে আসুক,পাঠকের সামনে সবার বই উন্মুক্ত হোক-এটাই আমাদের প্রত্যাশা৷

লেখকঃ নির্বাসনে থাকা নারী অধিকার বিষয়ক নিবন্ধ লেখক।