মাত্র সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার একটা তেল খনি নিয়ে এতো হৈচৈ কেনো?

আবদুল কাদের তাপাদার: সিলেটের ভূগর্ভে ১৯৫৫,১৯৮৬,২০১৪, ২০২০ সালে আবিষ্কৃত তেলখনির একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

সিলেটের জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, জকিগঞ্জের মাটিতে অফূরন্ত তেলের খনি।
বিশেষ করে জৈন্তাপুরের হরিপুরের আশপাশের ৪০/৫০ কিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের খনি ও ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা তেল অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন তিরিশ বছর আগে। তারা বলেছেন, দশ কিলো অন্তর অন্তর কূপ খনন করে তেলখনি নিশ্চিত হতে। সে পরামর্শ আজো বাস্তবায়িত হয়নি।

দেশে সর্বপ্রথম তেলখনি আবিষ্কৃত হয় পাথারিয়া পাহাড়ে ১৯৫৫ সালে। যার অবস্থান ভারতের আসাম সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি । অনেকেই জানেন যে, আসাম ভারতের সবচেয়ে তেল সমৃদ্ধ এলাকা।উত্তোলনের সময় সেটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কোটি কোটি ব্যারেল তেল আশপাশের ২০/২৫ কিলোমিটার এলাকার মাঠ ঘাট,
নদী জলাশয়, ফসলের মাঠ, বাড়ির পুকুর, উঠোনে
রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন নানারকম পাত্রে তেল সংগ্রহ করে ব্যবহার করেন। সেটা এক বেদনাবিধুর ইতিহাস।
তারপর সিলেটের ৭ নং কূপে ১৯ ৮৬ সালে তেলের খনি পাওয়া যায়। তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ খবর পেয়ে হেলিকপ্টারে ছুটে আসেন হরিপুর।
বেশ কয়েক বছর এই খনি থেকে তেল উত্তোলনের পর
তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় ।

২০১৩ সাল থেকে হরিপুর ৯ নম্বর কূপের কাজ শুরু হয়। ত্রি ডি( ত্রি ডাইমেনশন) জরিপে এই কূপে
বিশাল তেলখনি নিশ্চিত হওয়া যায়।
এই কূপের খবর নিতে আমি এবং জৈন্তাপুরের কয়েকজন সাংবাদিক ২০২০ সালে এই কূপের প্রকল্প পরিচালকসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হই।
আমরা কূপ এলাকায় ও গ্যাসফিল্ডের অফিসে সারাদিন ঘুরে বেড়াই। নানা ভাবে এই কূপের অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করি।
আমরা তাদের বক্তব্য নোট করি। তারা জানিয়েছিলেন,
এই ৯ নম্বর কূপে প্রায় দেড়কোটি মিলিয়ন ব্যারেল তেল তোলা যাবে। এবং এর আশপাশ এলাকায় আরো কূপ খনন করা হলে আগামীর বাংলাদেশ এই তেল দিয়েই চলতে পারবে।
এতো বড় সুসংবাদে আমি রীতিমতো আপ্লূত হয়ে পড়ি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন
বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিজ বিভাগের অধ্যাপক, সৌদি আরবের রিয়াদ পেট্রোলিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ডক্টর বদরুম ইমামের টেলিফোনে একটা সাক্ষাতকার নেই।

আমি এ বিষয়ে একটা বিশেষ রিপোর্ট তৈরি করে
রাস্ট্রীয়ভাবে ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলাম।
কিন্তু কোনো ঘোষণা আসছিলো না।

কয়েক মাস পর সংবাদপত্রে তেলসমৃদ্ধ ৯ নম্বর কূপ নিয়ে
একটা রিপোর্ট দেখে আমি রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যাই।
তেলের এই খনি থেকে গ্যাস উত্তোলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অর্থাৎ ৯ নম্বর কূপ একটা গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে এই কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হবে।
বাস্তবে তাই ঘটলো। এই কূপ থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলো।
ফলে এই কূপ নিয়ে লেখালেখির আমার তেমন আর আগ্রহ ছিল না।
প্রত্যেক তেলক্ষেত্রেই গ্যাসও থাকে।
আবার প্রত্যেক গ্যাসক্ষেত্রে তেলও থাকে।
তবে এর পরিমাণের তারতম্য থাকে অনেক।
যেমন : কৈলাশটিলার গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ১৮ প্রকার কনডেনসেট তেল উৎপাদন হয়।এটা তেলের উপজাত।
এই উপজাত থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকার এলএনজি উৎপাদন হচ্ছে।

৯ নম্বর কূপের বড় আকারের নিশ্চিত তেলখনি থেকে তেল উৎপাদনে না গিয়ে কেনো গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে তা রাস্ট্রের নীতি নির্ধারকরাই ভালো জানেন।
মাত্র দুইশো কোটি টাকার সামান্য বাজেটে দেশীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স এই অসাধারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে।

হরিপুরের এই ৯ নম্বর কূপের সাফল্যের আগে সিলেটের কৈলাশটিলায় দেশের সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় তেলখনির ঘোষণা দেয় সরকার। যেখানে দেশের ৫০ বছরের তেল সংকুলান হবে বলে বলা হয়েছিল। বেশ কয়েক মাস পর এখানে তেলখনি নেই বলে রাস্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দিলে দেশে তেল অনুসন্ধানের বিষয়টি একটা বিভ্রান্তির ধুম্রজালে আটকা পড়ে।
কৈলাশটিলা বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় তেল গ্যাস ক্ষেত্রের অন্যতম একটা বড় ক্ষেত্র।
এখন কৈলাশটিলা থেকে গ্যাস ও তেলের উপজাত বা বিপুল পরিমাণ কনডেনসেট উৎপাদন হচ্ছে।
তেলখনির গল্প গল্পই রয়ে গেছে।

এখন হঠাৎ করে আমাদের করিৎকর্মা জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ১০ নং কূপে তেলের খনির ঘোষণা দিয়েছেন।
এই কূপটি হরিপুরের অদূরে বাঘেরসড়ক এলাকায় অবস্থিত।এটি জৈন্তাপুরের সীমানার কাছে হলেও গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন।
এই ১০ নম্বর ক্ষেত্রকে একটা গ্যাস ক্ষেত্র হিসেবে
কর্তৃপক্ষের বক্তব্যসহ সিলেটের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সিলেটের ডাক সপ্তাহ খানেক আগে সংবাদ প্রকাশ করে। যেখানে শিগগিরই গ্যাস উত্তোলন করার কথা বলা হয়। কিন্তু রাতারাতি এই সংবাদের মৃত্যু ঘটেছে।

মন্ত্রী জানিয়েছেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ করে আরও ৪/৫ মাস পর তেলখনির মজুদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে এখানে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার তেল আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তাহলে এতো তাড়াতাড়ি এটা নিয়ে এতো হৈচৈ কেনো?

এই কূপ নিয়ে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন খনিজ সম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর বদরুল ইমাম।
তিনি এই তেলখনি নিয়ে উচ্চাভিলাষী না হতে সতর্ক করে দিয়েছেন। এবং এই এলাকায় আরও নতুন নতুন অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন।

রাজনৈতিক সরকারের সাফল্য প্রচার করতেই পারেন।
সামনে নির্বাচন এ ধরনের বিষয় প্রচারণার হাতিয়ার হতেই পারে। তাতে দোষের কিছু নেই।
কিন্তু আরও বড় আকারের কিছু একটা করে
প্রচারণা চালানো যেতে পারতো। তাতে ফায়দা আরও বেশি হতো বৈকি!

সিলেটে তেল গ্যাস ইউরেনিয়ামসহ ভূগর্ভে খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা অফূরন্ত। বিশাল।
সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুল হক( অবঃ) ও পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ মনসুরের সাথে
সিলেট গ্যাসফিল্ড বাংলোয় গত ২০১০ সালে আমি এই সম্ভাবনা নিয়ে একটা দীর্ঘ সাক্ষাতকার নেই।
দৈনিক জালালাবাদে এটা প্রকাশিত হয়।
তারা সিলেটের বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন।

এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে
বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে যেতে বাধ্য ইনশাআল্লাহ।
এজন্য রাজনৈতিক সরকারের সাহসিকতার পরিচয় দেয়া অপরিহার্য।
——————————————————————

আবদুল কাদের তাপাদার
সিনিয়র সাংবাদিক
সিলেট।
১১/১২/২০২৩

(বি:দ্র: লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)