সিলেট নগরীতে রিক্সা ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই
জাহেদ আহমদ:পূণ্যভূমি হিসেবে সিলেট হচ্ছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী। ব্যাস্ততম এই নগরবাসীর চলাচল বা যাতায়াতের অন্যতম প্রয়োজনীয় বাহন হচ্ছে রিক্সা। ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টির অন্যতম কারন হিসেবে রিক্সাকে চিহ্নিত করলেও রিক্সা ছাড়া যেন নগরবাসীর জীবন যাত্রাই অচল। সময়ের দাবীর প্রেক্ষিতে নগরীতে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে রিক্সার সংখ্যা। তাই রিক্সাই হয়ে উঠেছে নগরীর সংখ্যাঘরিষ্ট মানুষের যাতায়াতের অপরিহার্য বাহন। আর রিক্সার এই প্রয়োজনীয়তাকে পুজি করে নগরীতে রীতিমত ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চালাচ্ছে রিক্সাওয়ালারা। ভাড়া নিয়ে যাত্রী এবং রিক্সা চালকের এই বিতর্ক ও দুর করতে সিলেট সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ প্রথমে রিকশা ভাড়া নির্ধারন করে। তারপর নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ভাড়ার তালিকা সম্বলিত সাইনবোর্ডও স্থাপন করে। কিন্তু চালকরা নির্ধারিত ভাড়া নিতে নারাজ। তারা উল্টো যাত্রী সাধারনের কাছ থেকে ইচ্ছেমত ভাড়া আদায় করছে। অধিকাংশ চালকরা হয় তো রিক্সায় উঠার আগেই, নয় তো রিক্সা থেকে নামার পরই যাত্রীদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া দাবী করে। এ নিয়ে যাত্রী ও চালকের মধ্যে বাক-বিতন্ডা নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এ থেকে মুক্তি পেতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহনে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন সাধারন যাত্রীরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮৬৭সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট পৌরসভা। প্রথম পৌরসভা চেয়ারম্যান ছিলেন রায় বাহাদুর দুলাল চন্দ্র দেব। ২০০১ সালের ৯ এপ্রিল সিলেট পৌরসভা সিলেট সিটি কর্পোরেশনে উন্নিত হয়। বর্তমানে এর আয়তন প্রায় ২৮ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৭ লাখেরও বেশী। সিটি কর্পোরেশনে উন্নিত হবার পর প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বদর উদ্দীন আহমদ কামরান এবং সর্বশেষ নগর পিতা নির্বাচিত হন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। বর্তমান সিলেট মহানগর আয়তনে এবং জনসংখ্যায় যতটা বড় হয়েছে রাস্তা, ফুটপাত, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিনোদন ব্যবস্থা, যানবাহন শৃঙ্খলা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইত্যাদি নাগরিক সুযোগ সুবিধায় সিলেটবাসীর সীমাহীন ভোগান্তি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হবার পর বেশ কিছু নাগরিক সমস্যা দুর এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রিক্সাভাড়া নির্ধারণ করা। কিন্তু সিসিক কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়া আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন না করায় কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগ অনেকটা ভেস্তে যেতে চলেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, যাত্রী ও রিক্সা চালক ভাড়া নৈরাজ্য বা বিড়ম্বনার মূলে রয়েছে যাত্রী সাধারন কর্তৃক শহরে রিক্সা ভাড়ার হার না জানা এবং জানলেও মানতে চান না চালেকের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবির প্রেক্ষিতে রিক্সা ভাড়া ও ভাড়ার তালিকা সম্বলিত বোর্ড স্থাপন করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) কর্তৃপক্ষ। নগরীর প্রতিটি গুরত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে গত বছরের ২০ মে এ তালিকা সম্বলিত বোর্ড স্থাপন করে সিসিক কর্তৃপক্ষ। এর কয়েকমাস আগেই নির্ধারণ করে দেয়া হয় ভাড়ার তালিকা। মোড়ে মোড়ে ভাড়ার তালিকা সম্বলিত বিলবোর্ড স্থাপনেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সিসিকের কাজ। তবে তা বাস্থবায়নে সিসিকের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছেনা। তাই এ সুযোগ নিচ্ছে রিক্সা চালকরা। কোন চালকই মানছে না সিসিক কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়া।
সিসিক নির্ধারিত ভাড়ার তালিকার ব্যাপারে রিক্সা চালকদেরও অভিযোগ রয়েছে। তাদের দাবি নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা সংশোধন করা প্রয়োজন। এখানে বিভিন্ন রুটে যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তার মাধ্যমে তাদের পরিশ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি।
অপরদিকে ঠিক উল্টো বক্তব্য সাধারণ যাত্রীদের। তারা বলছেন, সিসিক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ভাড়া বেশি নির্ধারণ করেছেন। এটি সংশোধন করা প্রয়োজন। আরো কয়েকজনের বক্তব্য ভাড়ার তালিকা আছে। কিন্তু এটি বাস্থবায়নে সিসিককে কঠোর হতে হবে।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানাগেছে, রিক্সা ভাড়া নিয়ে সিসিক কর্তৃপক্ষ তালিকা দিয়েছে। এখন এটি বাস্থবায়নে নগরবাসীকে তালিকা অনুযায়ী ভাড়া প্রদান করা উচিত। এর মাধ্যমেই ভাড়া বাস্থবায়িত হবে।
এক নজরে সিসিক কর্তৃক নির্ধারিত রিকশা ভাড়ার তালিকা:
প্রতি কিলোমিটার ১০ টাকা ও প্রতি ঘণ্টা পঞ্চাশ টাকা। এছাড়া নগরীর কোর্ট পয়েন্ট থেকে টিলাগড় ৩০ টাকা, শিবগঞ্জ ২০ টাকা, মিরাবাজার ১০ টাকা, যতরপুর ১৫ টাকা, উপশহর (এ/আই/এফ/জি/এইচ ও জে ব্লক) ৩০ টাকা, উপশহর (বি/সি/ডি ও ই ব্লক) ২০ টাকা, নতুন ব্রিজ ২০ টাকা, মেন্দিবাগের নতুন ব্রিজ হয়ে দক্ষিণ সুরমা বাস টর্মিনাল ৩৫ টাকা, পুরাতন ব্রিজ হয়ে দক্ষিণ সুরমা বাস টার্মিনাল ২০ টাকা, নতুন ব্রিজ হয়ে রেলস্টেশন ৩৫ টাকা, পুরাতন ব্রিজ হয়ে রেলস্টেশন ২০ টাকা, পুরাতন ব্রিজ হয়ে বাবনা পয়েন্ট ২০ টাকা, পুরাতন ব্রিজ হয়ে টেকনিক্যাল ৩০ টাকা, নতুন ব্রিজ হয়ে কদমতলী ৩০ টাকা, পুরাতন ব্রিজ হয়ে কদমতলী ৩০ টাকা।
এদিকে, কোর্ট পয়েন্ট থেকে লাউয়াই ৪০ টাকা, বিসিক শিল্প নগরী ৪০ টাকা, খোজারখোলা ৩০ টাকা, বরইকান্দি ৩৫ টাকা, গোপশহর মকন দোকান ৪০ টাকা, ঝেরঝেরি পাড়া ১৫ টাকা, দর্জিবন্দ ১৫ টাকা, শাহী ঈদগাহ ২০ টাকা, সরকারি কলেজ ছাত্রাবাস ৩৫ টাকা, শিবগঞ্জ সোনাপাড়া ২০ টাকা, বালুচর ৩৫ টাকা, কাজীটুলা ১৫ টাকা, ইলেকট্রিক সাপ্লাই ২০ টাকা, উত্তর কাজীটুলা ২০ টাকা, গোয়াইটুলা ২৫ টাকা, আম্বরখানা ১৫ টাকা, লেচু বাগান ২০ টাকা, চৌকিদেখি ৩০ টাকা, লাক্কাতুরা ৩০ টাকা, হাউজিং এস্টেট ২০ টাকা, বাদাম বাগিচা ৩০ টাকা, মাছিমপুর ১৫ টাকা, দর্শন দেউরী ১৫ টাকা, রাজারগলি ১৫ টাকা, দরগাহ শাহজালাল গেইট ১০ টাকা।
কোর্ট পয়েন্ট থেকে মিরের ময়দান ১০ টাকা, সুবিদবাজার ১৫টাকা, গোয়াবাড়ী ৩০টাকা, আখালিয়াা বিডিআর ক্যাম্প গেইট ও শাবি ক্যাম্পাস গেইট ৩৫টাকা, বাগবাড়ী ২০টাকা, এতিম স্কুল ২০ টাকা, কানিশাইল খেয়াঘাট ৩০ টাকা, নবাব রোড (শেখঘাট পিচের মুখ, কলাপাড়া ডহর) ২০টাকা, ঘাসিটুলা বেতের বাজার ২৫টাকা, শেখঘাট ১০টাকা, ভাঙ্গাটিকর ১৫টাকা, ভাতালিয়া ১৫টাকা, রিকাবীবাজার ১৫টাকা, ওসমানী মেডিকেল ২০টাকা, দাড়িয়ায়পাড়া ১০টাকা, মির্জাজাঙ্গাল ১০টাকা, জল্লারপাড় ১০টাকা, পশ্চিম কাজিরবাজার ১০টাকা, ছড়ারপার ১৫টাকা, কুমারপড়া পয়েন্ট ১৫টাকা, কুমারপাড়া (ঝর্নারপাড়) ২০টাকা।
কোর্টপয়েন্ট থেকে কুমারগাঁও বাস টার্মিনাল ৪০টাকা, মিরাবাজার আগপাড়া ১৫টাকা, সোবহানীঘাট ১০টাকা, চালিবন্দর ১০টাকা, তোপখানা ১০টাকা, আম্বরখানা কলবাখানী ২০টাকা, পুরাতন ব্রিজ হয়ে ভার্থখলা ২০টাকা, পীর মহল্লা ২৫টাকা, মেন্দিবাগ ২৫টাকা, সাদাটিকর ৩০টাকা, কুশিঘাট ৩৫টাকা, শাপলাবাগ ৩৫টাকা, টুলটিকর ৪০টাকা ও মিরাপাড়া ৩৫টাকা ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিলেট সিটি কর্পোরেশন রিক্সা ভাড়া নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে এই কমিটির সদস্যরা কাউন্সিলর, রিকশাচালক, মালিক ও যাত্রীদের মতামতের ভিত্তিতে রিকশা ভাড়ার নতুন তালিকা নির্ধারণ করেন। রিকশা ভাড়ার তালিকায় প্রতি কিলোমিটার ১০ টাকা, প্রতি ঘণ্টা ৫০ টাকা রিকশা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। ভাড়া নির্ধারণের দীর্ঘ আট মাস পর নগরীর ৫১টি পয়েন্টে এ তালিকা স্থাপন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
বন্দরবাজারস্থ করিম উল্লাহ মার্কেটের কম্পিউটার ব্যাবসায়ী পিংকু দত্ত বিকু বলেন- আমি আখালীয়া থেকে আম্বরখানা হয়ে দোকানে আসি। কিন্তু আম্বরখানা থেকে বন্দরবাজার নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা হলেও ২০ টাকা ছাড়া রিক্সা যেতেই চায়না। আর আবহাওয়া খারাপ হলে তো কথাই নেই। ড্রাইভার যত চাইবে তত টাকাই দিতে হবে। অন্যথায় রিক্সা জুটবে না।
নগরীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আব্দুল আউয়াল মিসবাহ বলেন- জালালাবাদ থেকে আমার অফিস দরগাগেইট এলাকায়। এইটুকু জায়গা আসতে সিসিক নির্ধারিত বাড়া ১০ টাকা হলেও ২০ থেকে ২৫ টাকা ছাড়া রিক্সা যেতেই চায়না।
এব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ এর সিলেট বিভাগীয় সেক্রেটারী দিলোয়ার হোসেন বলেন- সিসিক কর্তৃপক্ষ রিক্সাভাড়া নির্ধারন করে ভাড়ার তালিকা টানিয়ে একটি ভালো ও সময়োপযোগি কাজ করেছে। কিন্তু তা কার্যকরের কোন উদ্যোগ না নিলে এর কোন মূল্য থাকলো না। আমরা আশা করি রিক্সা শ্রমিক, রিক্সা মালিক ও সিলেটের সুধীজন নিয়ে পুনরায় ভাড়া নির্ধারন করে তা কার্যকরের উদ্যোগ নিবেন সিসিক কর্তৃপক্ষ।
এব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন- আমরা ভাড়া নির্ধারন করে দিয়েছি। চালকদের এই ভাড়াই নিতে হবে। ভাড়া নিয়ে বিড়ম্বনার ব্যাপারে তিনি বলেন- এধরনের কোন অভিযোগ আমাদের কাছে আসে নি। অভিযোগ আসলে ব্যাবস্থা নেয়া হবে।