নিরাপত্তাহীন সিলেট: অনিয়ন্ত্রিত সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রলীগ

ফখরুল ইসলাম: মুরারিচাঁদ কলেজ (সংক্ষেপে: এমসি কলেজ): বাংলাদেশের একটি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি সিলেট শহরের টিলাগড় এলাকায় অবস্থিত এবং বৃহত্তর সিলেটের সবচাইতে পুরনো ও শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠাকালের দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোর মধ্যে ৭ম; কলেজটি ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্যবাহী এ কলেজটি
দিন-দিন তার নামে কালিমা লেপন করে চলছে। আর এ কাজটি করছে টিলাগড় ছাত্রলীগের কিছু বখাটেরা। কখনো সংঘর্ষ, কখনো খুন, কখনো দখল, কখনো আগুন। এভাবে একের পর এক অপকর্ম করে চলছে টিলাগড় ছাত্রলীগ। সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার রাতে সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে এ ঘটনা ঘটে। করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্রাবাস বন্ধ ছিল। তবে ছাত্রাবাসের ওই কক্ষ ২০১২ সাল থেকে ছাত্রলীগের দখল করা কক্ষ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ উঠেছে, ওই কক্ষে থাকা ছাত্রলীগের একটি পক্ষের ৭-৮ জন কর্মী এ ঘটনায় জড়িত।
খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার একদল পুলিশ সেখানে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে উদ্ধার করে। এ সময় অভিযুক্ত ধর্ষকদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ফেলে যাওয়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আর ওই দম্পতির ব্যবহৃত ব্যক্তিগত গাড়িটি উদ্ধার করা হয়েছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোহা. সোহেল রেজা নিউজচেম্বারকে
বলেন, স্বামীকে আটকে রেখে কয়েকজন যুবক তাঁর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ছাত্রাবাসের নির্জন স্থানে ধর্ষণ করেছেন। ধর্ষণকারীদের শনাক্ত করে আটক করতে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে।

শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে যোগাযোগ করলে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোতির্ময় সরকার নিউজচেম্বার-কে বলেন, শুক্রবার রাত তিনটা থেকে ছাত্রাবাসসহ আশপাশের এলাকায় অভিযান হয়েছে। ধর্ষণকারী শনাক্ত ও গ্রেপ্তার বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। তিনি জানান, ওই তরুণীকে রাত ১২টার দিকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে (ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার) ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা মোটরসাইকেলটির মালিকের সূত্র ধরে ধর্ষণকারী শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের ভাষ্য, ওই তরুণীর (২০) বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমায়। স্বামীর সঙ্গে নিজেদের গাড়িতে করে শুক্রবার বিকেলে এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে যান। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে গাড়িটি রেখে একটি দোকান থেকে তাঁরা কেনাকাটা করেন। পরে ফিরে গাড়িতে বসে গল্প করছিলেন তাঁরা। রাত আটটার দিকে পাঁচজন যুবক তাদের গাড়িটি ঘিরে ধরে স্বামী ও স্ত্রীকে জোর করে গাড়ি থেকে নামান। তিনজন যুবক তরুণীকে টেনে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। স্বামীকে তখন গাড়িতে আটকে রেখেছিলেন দুজন যুবক। ঘণ্টাখানেক পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে গিয়ে স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পান।
শুধু এখানেই শেষ নয়, এমসি কলেজের হল পোড়ানো, হল ভাংচুর, অস্ত্রবাজি, খুন- সকল অপকর্মেই এগিয়ে টিলাগড় ছাত্রলীগ।

সিলেটে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে ‘টিলাগড় ছাত্রলীগ’। ছাত্রলীগের এই বলয়ের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস ও অপকর্মে বিতর্কে জড়াচ্ছে পুরো ছাত্রলীগ।
টিলাগড়কেন্দ্রীক আওয়ামী লীগের দুই নেতার বিরোধের কারণে নিয়মিতই সংঘাতে জড়াচ্ছে তাদের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতারা। টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজ, সরকারি কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বজায় রাখতেও সংঘাতে জড়াচ্ছে এই দুই নেতার অনুসারীরা। ফলে ছাত্রলীগের ‘কাঁটা’ হয়ে উঠেছে টিলাগড় বলয়ের নেতাকর্মীরা।

সংঘাত, প্রাণহানি, ছাত্রাবাস ভাংচুরসহ বিভিন্ন ধরণের অপকর্ম করেও শুধু নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। ফলে ধারাবাহিকভাবেই ঘটছে সংঘাত। সিলেটে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৭ বছরে ঘটেছে ৮টি প্রাণহানির ঘটনা। যার তিনটিই ঘটেছে টিলাগড় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে।

জানা যায়, টিলাগড় ছাত্রলীগের একটি অংশকে নেতৃত্ব দেন হিরন মাহমুদ নিপু। যিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক এডভোকেট রনজিত সরকার অনুসারী বলে পরিচিত। আর অপর অংশের নেতৃত্ব রয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম. রায়হান আহমদ চৌধুরী। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমসি কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী, টিলাগড় এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা ছাত্রলীগের কোন্দলের ফলে ভোগান্তির কথা জানিয়ে বলেন, টিলাগড় এলাকার মানুষ সব সময়ই আতঙ্কে থাকতে হয়। এখানকার দুই নেতার প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যে সখ্যতা অপরদিকে নিজেদের অনুসারীদের মধ্যে দা-কুমড়ার এই সম্পর্কের কারণে এখানকার সবাই অতিষ্ঠ।
এব্যাপারে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ নিউজচেম্বার টুয়েন্টফোর ডটকম-কে বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল মীমাংসা করে ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবুও নিজেদের অজান্তেই এই ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই আমরা এখন থেকে কঠোর অবস্থানে থাকবো। তাছাড়া এই ধরণের ঘটনা যারা ঘটায় তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদানের ব্যাপারে আমরা প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।