সর্বশেষ

» নূর হোসেনের মৃত্যু এরশাদ সরকারের কতটা মাথাব্যথা তৈরি করেছিল

প্রকাশিত: ১০. নভেম্বর. ২০২০ | মঙ্গলবার

সেইদিন পুলিশের গুলিতে আরও দুইজন নিহত হয়েছিল। কিন্তু শরীরে গণতন্ত্রের বার্তা লেখা এই যুবক গুলিতে নিহত হওয়ার পর সামরিক শাসনবিরোধী গণআন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। ওই চত্বরটির নামকরণ করা হয় নূর হোসেন চত্বর।

 

নূর হোসেনের মৃত্যু নিয়ে পরবর্তী সময় অনেক গল্প-কবিতা-গান লেখা হয়েছে।

 

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর যখন নূর হোসেন পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহত হন, তখনকার সংবাদপত্রে সেই ঘটনা ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছিল। এরপরের কয়েকদিন জুড়ে ঢাকায় বিক্ষোভ-সংঘর্ষ চলতে থাকে।

 

সেই সময়ে এরশাদ সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ তার ‘চলমান ইতিহাস : জীবনের কিছু সময় কিছু কথা:১৯৮৩-১৯৯০’ গ্রন্থে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তারিখের আন্দোলন, গুলিতে হতাহতের কথা উল্লেখ করলেও সেখানে নূর হোসেনের প্রসঙ্গে কিছু লেখেননি।

 

মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘১৯৮৭ সালের অক্টোবর নাগাদ আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে।….এমতাবস্থায় দুই প্রধান রাজনৈতিক জোট একটি যুক্ত ঘোষণার মাধ্যমে ১০ নভেম্বর রাজধানীতে ১০ লাখ লোকের এক বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ ঘটানোর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করে।….এরশাদ এবং তাঁর সরকার এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়।’

 

সেই সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে মওদুদ আহমদ তার বইতে লিখেছেন, ‘বিরোধী দলসমূহের এই কর্মসূচীকে প্রতিহত করার জন্য সরকার দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে জনসমাবেশ ও মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের আটক করা হয়, গ্রামাঞ্চল থেকে লোকজন যাতে শহরের দিকে আসতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে লঞ্চ ও ট্রেনের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয় ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নিয়মিত আইন রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিডিআর মোতায়েন করা হয়।’

 

‘সরকারের গৃহীত এসব পদক্ষেপ বানচাল করার জন্য বিরোধী দলগুলো পর্যাপ্ত জনসমর্থন সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জনসভাটি অন্য জনসভার চেয়ে আকারে বড় হলেও তেন কোন সফলতা অর্জন করতে পারেনি।’

 

‘এভাবে ১০ নভেম্বর সরকারবিরোধী আন্দোলন সরকারের দৃষ্টিতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের তীব্রতা কমেনি, বরং ক্রমশ তা ঘনীভূত হতে থাকে।’ লিখেছেন মওদুদ আহমদ।

 

কিন্তু বইয়ের কোথাও নূর হোসেনের উল্লেখ করেননি তখনকার উপ-প্রধানমন্ত্রী, পরবর্তীতে এরশাদর সরকারের প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ। এ থেকে বোঝা যায়, নূর হোসেনের মৃত্যুর বিষয়টি সরকারের ওপর মহল ততোটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি।

 

এরশাদ সরকারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘সেই মৃত্যু নিয়ে তখনো সরকারের ওপর মহলে কোন আলোচনা হয়নি, পরবর্তীতেও হয়নি। সরকারে বা দলের মধ্যে এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি।’

 

‘তৎকালীন বিরোধী দলের সঙ্গে একপ্রকার আলোচনা হয়েছিল যে, তারা মিছিল নিয়ে এসে চলে যাবেন। কিন্তু তারা এসে একটা অবস্থান নিয়ে নিয়েছিলেন। তখন পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। নূর হোসেন কোথা থেকে আসলো, আমার জানা নেই।’

 

এ নিয়ে তখনকার মন্ত্রিসভায় বা দলে কখনো কোন আলোচনা হয়নি, বলে বলছেন মঞ্জু।

 

সেই সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান আর উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (বর্তমানে বিএনপি নেতা), যারা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।

 

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, এরশাদের সময়কাল বইয়ে ড. মোহাম্মদ হাননান লিখেছেন, নূর হোসেন নিহত হওয়ার পরের দিন, ১১ নভেম্বর (১৯৮৭) ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে এক জনসভায় জেনারেল এরশাদ তার পরিবর্তে বিরোধী দলের নেতাদেরই পদত্যাগ করার পরামর্শ দেন।

 

তিনি বলেন, ‘১০ নভেম্বর বিরোধী দল ৫০ লাখ লোকের ঢাকা সমাবেশ করবে বলে পরিকল্পনা করছিল, কিন্তু তারা ৫ হাজার লোকও আনতে পারেনি।’

 

তখনকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রেসনোটে বিরোধীদের দেখামাত্র গুলি কারর কথা বলা হয়। ১২ নভেম্বর সংঘর্ষে একজন পুলিশসহ দুজন নিহত হন।

 

১০ নভেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়, ‘আন্দোলনের নামে পরিচালিত ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় বিপন্ন হয়ে পড়া জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করতে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’

 

‘শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনজীবনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। সরকার আশা করেন যে, সংশ্লিষ্ট সকল মহল ভবিষ্যতে এ ধরণের কর্মতৎপরতা হতে বিরত থাকবেন’, উল্লেখ করা হয় ওই প্রেসনোটে।

 

অবশ্য নূর হোসেনের মৃত্যুর পরবর্তী কয়েকদিন পর্যন্ত তার নাম ততোটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি। বুকে-পিঠে গণতন্ত্রের বাক্য লেখা থাকলেও অনেকেই তার নাম জানতেন না। সেইদিন নূর হোসেনের পাশাপাশি পুলিশের গুলিতে আরো দুইজন কর্মীও নিহত হয়েছিলেন।

 

তবে বুকে পিঠে গণতন্ত্রের বাক্য লেখা নূর হোসেনের কয়েকটি ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে নূর হোসেন সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

 

নূর হোসেন নিহত হওয়ার পরের দিন, ১১ই নভেম্বর ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল, ‘ঢাকায় মিছিল সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিতে নিহত ৪’। বাংলাদেশ টাইমসের শিরোনাম ছিল, ‘থ্রি কিলড, হানড্রেড হার্ট’।

 

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘নূর হোসেনের আগে ও পরেও আরও অনেকেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। কিন্তু এসব মৃত্যু নিয়ে তখনকার সরকার বা দলের মধ্যে কোন মাথাব্যথা ছিল বলে দেখা যায়নি। একদিকে আন্দোলন চলেছে, আরেকদিকে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ-সহিংসতায় হয়েছে। নূর হোসেনের মৃত্যু নিয়েও ক্ষমতায় থাকার সময় জাতীয় পার্টি বা এরশাদ সরকারের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।’

 

‘তবে এরপর যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তারই ফলশ্রুতিতে কয়েক সপ্তাহ পর ৬ই ডিসেম্বর এরশাদ পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হন। এবং আন্দোলনের পরবর্তী ধারাবাহিকতায় তার পতনও ঘটে।’ তিনি বলছেন।

 

তিনি জানান, তবে ১৯৯৬ সালে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

 

নূর হোসেনকে নিয়ে পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি
১৯৯৭ সালে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা আর অব্যাহত রাখা হয়নি।

 

আওয়ামী লীগ দিনটিকে নূর হোসেন দিবস হিসাবে পালন করতে শুরু করলেও জাতীয় পার্টি এই দিনটিকে গণতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করতে শুরু করে।

 

কিছুদিন আগে বিবিসি বাংলার কাছে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছিলেন, জেনারেল এরশাদ যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন জাতীয় পার্টির সরকারের অনেক মন্ত্রী বিশ্বাস করতেন যে নূর হোসেনকে দিয়ে তাদের নেতার পতন ত্বরান্বিত করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল।

 

সম্প্রতি জাতীয় পার্টির একটি অনুষ্ঠানে তিনি নিহত তরুণ নূর হোসেনকে ‘ইয়াবাখোর ফেনসিডিলখোর’ বলে কটূক্তি করার পর প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়েন।

 

পরবর্তীতে চাপের মুখে মশিউর রহমান রাঙ্গা তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন।

 

বিবিসির প্রশ্নের জবাবে, জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে জে. এরশাদকে কটূক্তি করে দেওয়া স্লোগানের প্রতিক্রিয়ায় তিনি ওই মন্তব্য করেন।

 

‘‘সেদিন আওয়ামী লীগের সভায় ‘এরশাদের দুই গালে জুতো মারো তালে তালে’ ধরণের শ্লোগানে আমাদের কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তারা বলছিলো, আমরা যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শরিক, সেখানে এমন শ্লোগান কেন হবে।’

 

‘সে সময় আমি বলি, নূর হোসেন সেদিন অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন, নিজের বুকে কেউ নিজে লিখতে পারে না, কেউ হয়ত লিখে দিয়েছিল।’

 

রাঙ্গা স্বীকার করেন নূর হোসেন সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার সময় ‘দুটো শব্দ বের হয়ে গিয়েছিল।’

 

‘আমি ওই শব্দ দুটো আর ব্যবহার করতে চাইনা। আমি দুঃখিত। আমি অনুতপ্ত। আমার ভুল হয়েছে। আমি তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।’

 

গোরখোদকরা জানতেন না কার লাশ কবর দিচ্ছেন
জুরাইন গোরস্তানের কবরখোদক আলমগীরের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘শহীদ নূর হোসেন’ গ্রন্থে তখন ভোরের কাগজের সম্পাদক (বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক) মতিউর রহমান উল্লেখ করেছেন, পুলিশ-বিডিআর তাড়াহুড়ো করে তাকে কবর দিতে বলেছিল। তার বুকে পিঠে লেখাগুলো তারা চেষ্টা করেও তুলতে পারেননি।

 

‘তার বুকে পিঠে লেখা ছিল, সেগুলো ঘইষ্যা তুলতে পারি নাই। পুলিশ-বিডিআর খুব তাড়াহুড়ো করছিল। তাড়াতাড়ি কবর দিতে কইছিল। সেদিন তো জানি না ওটা নূর হোসেনের লাশ ছিল। পরে জানতে পারি, ওই দেয়ালের পাশের কবরটিই হলো শহীদ নূর হোসেনের।’ সেই রাতের অভিজ্ঞতা মতিউর রহমানের কাছে বর্ণনা করেন গোরখোদক আলমগীর।

 

‘শহীদ নূর হোসেন’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে তিনজনের মৃতদেহ নিয়ে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের গাড়ি এসেছিল এই কবরস্থানে। সঙ্গে এসেছিলেন পাঁচ-ছয় ট্রাক বিডিআর ও পুলিশ সদস্য। তাদের তাড়াহুড়ো ছিল, চাপ দিচ্ছিলেন দ্রুত কবর দেয়ার জন্য। তাদের চাপের কারণে পুরোপুরি ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী ওই তিনজনের লাশ দাফন করা যায়নি।

 

বইটির লেখক মতিউর রহমানকে নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমান জানান, কোনো একটি পত্রিকার মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, জুরাইনে নূর হোসেনের কবর দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ১৩ নভেম্বর তিনি সেখানে যান। গোরখোদকদের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছেলের কবর শনাক্ত করেন।

image_print
           

সর্বশেষ

আর্কাইভ

September 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30